ঢাকা: ২১ আগস্ট ২০০৪ বিকেল ৫টা ২২ মিনিট। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর সামনে ট্রাকের ওপর বানানো মঞ্চে নিজের বক্তব্য শেষ করলেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা।স্লোগান দিলেন ‘জয় বাংলা… জয় বঙ্গবন্ধু’ মুহূর্তেই বিকট শব্দে কেঁপে উঠল মঞ্চটি। এরপর একে একে আরও বেশ কয়েকটি জোরালো শব্দ, চারদিকে ধোঁয়া।
এর মাঝ থেকে ছুটে আসছে শত শত মানুষের আর্তনাদ। রাস্তায় পড়ে আছেন আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী-সমর্থক।ট্রাকের ওপর মানব দেয়াল ঢেকে রেখেছে বাংলাদেশের স্থপতির মেয়েকে।
২০ বছরের আগের এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্যতম দিন।দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার জঘন্য অপচেষ্টার দিন। দেশের মানুষ আজও কেঁপে ওঠেন শনিবার দিনটির কথা ভেবে। কত শত মানুষ মনের অজান্তে কেঁদে ফেলেন। স্বজন হারানোরা খুঁজে ফেরেন প্রিয় মানুষের স্মৃতি। অনেকের মনে প্রশ্ন- কেন এসেছিল ২১ আগস্ট ২০০৪?
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এদিন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ। যে ট্রাকটিকে (ঢাকা মেট্রো-ট-১১-৩০৯৮) উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয়েছিল, সেটিকে ঘিরে শনিবার বিকেল ৪টা থেকেই দলীয় ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভিড় করছিলেন। পুরো এলাকা জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে মুখরিত ছিল। বিকেল ৫টায় সমাবেশ স্থলে আসেন শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টা ২ মিনিটে মঞ্চে উঠে বক্তব্য শুরু করেন। টানা ২০ মিনিট বক্তব্য দিলেন। বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে নিজেই জয় বাংলা..জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মাইক নামাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই শুরু জঘন্যতম সময়ের মুহূর্ত।
মঞ্চের দক্ষিণ পাশ থেকে ছোড়া একটি গ্রেনেড একেবারে কাছে এসে পড়ে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডটি। মঞ্চ টার্গেট করে দক্ষিণ পাশ থেকে একে পর এক গ্রেনেড হামলা হতে থাকে। মাত্র দেড় মিনিটে ব্যবধানে ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ হয় সমাবেশ স্থলে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রক্ষায় তৈরি করে ফেলেন মানব দেয়াল। মঞ্চে এ অবস্থায় থাকেন কিছুক্ষণ। পরিস্থিতি বুঝে বঙ্গমাতার মেয়েকে ট্রাক থেকে নামিয়ে তার বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। ওই গাড়ি লক্ষ্য করেও গুলি ছোঁড়ে হামলাকারীরা।
২১ আগস্টের ওই ঘটনায় নিজ নেতা-কর্মীদের নিয়ে রাস্তায় বসেছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমান। গ্রেনেডে আঘাতে তাৎক্ষণিক গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় তার। তিনিসহ মোট ২৪ জন হামলার ঘটনায় নিহত হন। আহত হন দল ও সংগঠনের কয়েকশ নেতাকর্মী-সমর্থক।
ওই কালোদিনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। রাস্তায় পড়ে ছিল অগণিত রক্তসহ জুতা, স্যান্ডেল। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডও পড়ে ছিল কয়েকটি। এ হামলায় মানব দেয়ালের কারণে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দুই কান ও চোখ। অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার শ্রবণশক্তির।
আজ রোববার (২১ আগস্ট) সেই রক্তস্নাত ভয়াবহ বিভীষিকাময়, বর্বরোচিত ও বীভৎস হত্যাযজ্ঞের আঠারোতম বার্ষিকী।
২০০৪ সালের তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারের শাসনামলে এ নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো- আজ হয়ত বঙ্গবন্ধু কন্যা বেঁচে থাকতেন না। মারা পড়তেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এমন পৈশাচিক হামলা চালায় ঘাতকরা।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথম দফায় হামলার পর স্টেডিয়ামের দিক হয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত শেখ হাসিনাকে সরিয়ে নেওয়া হয়। দলীয় সভাপতি যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনও একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একইসঙ্গে চলছিল তার গাড়ি লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি। এসব গুলি ও গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল, তা বোঝা না গেলেও বেশ পরিকল্পিতভাবে যে হামলা হয়েছে, তা পরে বোঝা যায়।
ধানমন্ডির সুধা সদনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়িটি পৌঁছানোর পর সেটির সামনে-পেছনে গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের অসংখ্য চিহ্ন দেখা গেছে।
ঘটনাস্থলে যারা হতাহত হয়েছিলেন, তাদের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে সেদিনকার প্রত্যক্ষদর্শীরা কেঁপে ওঠেন। জানান, চারদিকে ছোপ ছোপ রক্ত আর মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় অ্যাভিনিউ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশা-ভ্যানে করে আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অনেককে দেখা যায় রাস্তায় পড়ে আকুতির চোখে সাহায্যের আবেদন করছেন, তাদের মুখে রা নেই। দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ আহতদের সহায়তা ও হাসপাতালে নেওয়ার কাজে এগিয়ে এলেও এ সময় পুলিশ ছিল নীরব।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগ কর্মীরা সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এদিকে ঘটনার পর সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তখন পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে।
এ ঘটনায় মামলা করে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক জিয়া, চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৫২ জনকে আসামি করা হয়।
ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তে শুরু হয় নানা নাটক। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রাণ ফিরে পায় মামলাটি। বেশ কয়েকবার বাঁক বদলের পর বেরিয়ে আসতে থাকে আসল রহস্য। মূলত, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ইতিহাসের নৃশংসতম এ গ্রেনেড হামলা চালায়।
২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেনেড হামলার তদন্ত ফের শুরু হয়। নেপথ্যের অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উচ্চপর্যায়ের মদদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, সিআইডি ও পুলিশের তখনকার উচ্চ পদস্থ অনেক কর্মকর্তা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ব্যাপারে অবহিত ছিল এবং অনেকেই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে হামলায় জড়িতও ছিলেন। এছাড়াও হামলায় ব্যবহার করা হয় পাকিস্তানের তৈরি ‘আর্জেস গ্রেনেড’।
সাক্ষ্য প্রমাণে বের হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে বৈঠক করেই এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তৎকালীন বিরোধীদলের নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করার। আবদুল সালাম পিন্টুর ভাই জঙ্গি তাজউদ্দিনের সম্পৃক্ততা এবং আর্জেস গ্রেনেড ঘাতকদের হাতে হস্তান্তর করার তথ্য প্রমাণ বের হয়ে আসে। আসামিদের জবানবন্দীতেই হামলার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের ওই সময়ের পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার ও এনএসআইয়ের মহাপরিচালক আবদুর রহিম, জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও মন্ত্রী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর), জঙ্গীনেতা তাজউদ্দিন, মাওলানা ফরিদ, মুফতি আবদুল হান্নান (অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর), মাওলানা আবদুল সালাম এবং কাশ্মীরি জঙ্গী আবদুল মাজেদ ভাটের নামসহ সংশ্লিষ্ট সব ঘটনা ও জড়িতদের বৃত্তান্ত উঠে আসে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা সংক্রান্ত মামলা এখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
ভয়ংকর সেই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় মোট ১১ আসামিকে। বাকি তিনজনের মধ্যে হুজি-বি নেতা মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলমের ফাঁসি কার্যকর হয় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর হামলার অপরাধে। গ্রেনেড হামলা মামলায় আরেক আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। তাই তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আসামিদের মধ্যে লুৎফুজ্জামান বাবর এবং আব্দুস সালাম পিন্টুসহ অনেকেই বর্তমানে কারাগার থেকে মুক্তি। রায় ঘোষণার সময় তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৮ জনকে মামলার নথিতে পলাতক দেখানো হয়েছিল। পরে পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাইদ হাসান এবং ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার ওবায়দুর রহমান খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ইকবাল নামে এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সর্বশেষ পলাতক আছেন ১৫ জন। এরমধ্যে অন্তত ৯ জন বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।