বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, আওয়ামী লীগকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বাধাগ্রস্ত করা উচিত নয় এবং ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা উচিত নয়।
তবে ইউএনবিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে গণবিরোধী তৎপরতা এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে দলটি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং জনগণ ও তরুণ প্রজন্ম থেকে ক্রমবর্ধমানভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকার এবং দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পক্ষের দ্বারা পরিচালিত সম্ভাব্য ১/১১-স্টাইলের বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ফখরুলের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তিন পর্বের সিরিজের এটিই প্রথম প্রতিবেদন, যেখানে তিনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের সংস্কার উদ্যোগ, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং দলের কাউন্সিলসহ বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র চাই তাহলে আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হবে? আওয়ামী লীগের মতো পুরনো একটি রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তাহলে জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ থাকা উচিত,’ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাধাগ্রস্ত করার পক্ষে মতবিরোধ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তার উপলব্ধি ও উপলব্ধির ভিত্তিতে বিএনপির এই নেতা বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরে এত বড় ঘটনা ও পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করেনি। তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং আমি মনে করি, এটাই দলের জন্য সঠিক কৌশল ছিল।
ফখরুল বলেন, নির্বাচন বর্জন সব সময় গণতান্ত্রিক দলের জন্য সঠিক পন্থা নয়। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে অনেক সময় নির্বাচন বয়কট করা হতে পারে, যেমনটা আমরা করেছি, সেটা বৈধ সিদ্ধান্ত ছিল। তবে, যখন কোনও দল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, তখন পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ কয়েকটি পথ থাকে এবং নির্বাচনে অংশ নেওয়া সেই পথগুলির মধ্যে একটি যা এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুসরণ করা উচিত।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা বা নির্বাচন থেকে নির্দিষ্ট দলকে বাদ দেওয়ার নেতিবাচক প্রবণতা একটি ত্রুটিপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। যেমন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা কোনো ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলাফল কী হয়েছে? জামায়াত এখন রাজনীতিতে ফিরেছে। তাই সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া সঠিক পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি না।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে নৃশংস ভূমিকার জন্য আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলেও দেশের মানুষ তাদের পরিত্যাগ করবে।
তবে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কতটুকু সমীচীন হবে তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।
জার্মানিতে নাৎসি পার্টি ও ইতালিতে মুসোলিনির ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন বিএনপি মহাসচিব। আমার মতে, গণতন্ত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাজ করা উচিত এবং গণতান্ত্রিক চর্চা অবশ্যই কার্যকর থাকা উচিত। একটি ফ্যাসিবাদী দলকে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, কিন্তু আমরা কীভাবে গ্যারান্টি দিতে পারি যে এটি ভিন্ন ছদ্মবেশে পুনরুত্থিত হবে না? পশ্চিমা বিশ্বে কী ঘটছে দেখুন; নাৎসিপন্থী দলগুলো সামনে আসছে।
ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত না হলে দেশের জনগণ যে কোনো দলের অপকর্মের জবাব দেবে এবং ফ্যাসিবাদী দলের কর্মকাণ্ড মোকাবেলার পথ খুঁজে বের করবে। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাকেও সমর্থন করি না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩ সংশোধনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে, যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার জন্য একটি রাজনৈতিক দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার বিধান রাখা হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থানের কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী হবে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। একটি দল যখন আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়, তখন সে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং গণদাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই হয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাদের আস্থার ক্রমহ্রাসমান হওয়া। আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে দলটি কার্যকরভাবে জনগণের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে পারবে কিনা এবং তাদের আস্থা ফিরে পাবে কিনা তা অনিশ্চিত।
ফখরুল বলেন, ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব কোনো দলই নিতে পারে না, কারণ এটি ছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের দ্বারা চালিত সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণে একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।
কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও উপদল বিএনপিকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এটা দেশি-বিদেশি পক্ষের ষড়যন্ত্রের ফল। আমরা আবারো বিরাজনীতিকরণ ও বিদ্বেষপূর্ণ চক্রান্ত ১/১১-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। সুতরাং আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যেহেতু বাংলাদেশের সরকার রাজনীতিকে সম্পৃক্ত না করে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না।
বিএনপির এই নেতা বলেন, বুদ্ধিজীবী, আমলা ও টেকনোক্র্যাট শ্রেণির দ্বারা নয়, জনগণের সঙ্গে যাদের সত্যিকারের সংযোগ রয়েছে তাদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হওয়া উচিত।
