সিলেট মহানগর বিএনপির কমিটি নিয়ে বিতর্ক থামছেই না। এবার প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়লেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) সাবেক মেয়র ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী।
গত বুধবার সন্ধ্যায় সিলেট নগরীর দরগা গেট এলাকার একটি রেস্তোরাঁর হল রুমে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), সিলেট জেলা আয়োজিত আলোচনা সভা ও জুলাই-২৪ বিপ্লবে চিকিৎসাসেবায় অবদানের জন্য চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে বিএনপিতে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। সবখানে নতুন নেতৃত্ব আসবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, যারা আন্দোলন করবে, জেলে যাবে, যাদের ওপর মামলার পর মামলা হবে, দলের সব সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে নিবে তাদের কাউকেই কমিটিতে রাখা হবে না।’
নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের পদ বঞ্চিত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আর মুখ বন্ধ করে বসে থাকব না। হাজার হাজার নির্যাতিত নেতা-কর্মী, এম ইলিয়াস আলীর মতো অনেকে গুম হয়েছেন। কয়জনের খবর আমরা নিয়েছি? আজকে কমিটিতে ব্যবসায়ী, আমলাদের ধরে নিয়ে আসছেন। আর এখানে তারা বসছেন, কে হবেন সিনিয়র সচিব? কে হবেন নেক্সট গভর্মেন্টের পিএস?’
ত্যাগী নেতা-কর্মীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, আমরা কি শঙ্কামুক্ত? ভাব এমন যেন, আমরা ক্ষমতায় এসে গেছি। কিন্তু দিল্লি বহু দূর।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা কথা বলার স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু দলের ভেতর থেকে বৈষম্য সরিয়েছেন কি না? দলের ভেতরে যে বৈষম্য রয়েছে, তার কী হবে? আমরা পদের প্রতিযোগিতায় নেমেছি। যারা মাঠে ময়দানে আন্দোলন করল, যারা জেলে গেল, যারা নির্যাতিত হলো, যারা আজও মামলায় হাজিরা দিতে দিতে তাদের জীবন শেষ হলো, তাদের প্রতি আমরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছি, আমাদের চিন্তা করা প্রয়োজন।’
আরিফুল হক আরও বলেন, ‘আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, গত ১০ বছরে কারা চাকরি পাননি, তাকে কয় ধাপ প্রমোশন দিয়ে আমরা কোন জায়গায় বসাবো? দলের যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করেছে, তাদের জন্য কী করেছেন? আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, সবাই শহিদ জিয়ার আদর্শে সৈনিক আর সবাই বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের হাতকে শক্তিশালী জন্য কাজ করেন। একবার চিন্তা করেন, ওদের ব্যবসা-বাণিজ্য সবই ঠিক ছিল। আজকে আবার দেখা যাচ্ছে, তারা আবার ইস্ত্রি করা স্যুটকোট পরে বলে তোমরা যারা রাজপথে ছিলে তোমরা চলে যাও, আমরা আছি।’
উল্লেখ্য, গত ৪ নভেম্বর বিকালে সিলেট মহানগর বিএনপির ১৭০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়। এর ২০ মাস আগে আগে গত বছরের ১০ মার্চ সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে মহানগর বিএনপির সভাপতি পদে নাসিম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক পদে ইমদাদ হোসেন চৌধুরী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক পদে সৈয়দ সাফেক মাহবুব নির্বাচিত হন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে দেশের বাইরে অবস্থান করায় সভাপতির পদ থেকে নাসিম হোসাইনকে সরিয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর নতুন কমিটিতে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় রেজাউল হাসান কয়েস লোদীকে।
কমিটি ঘোষণার পর এনিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ‘আওয়ামীঘেঁষা ব্যক্তি’, সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় অনেকেই এ কমিটিতে আছেন বলে অভিযোগ করেছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, ত্যাগী অনেক নেতাই কমিটিতে ঠাঁই পাননি। এমনকি যারা বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন, তারাও নেই। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পরপরই বিএনপির একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়। এ অবস্থায় সংগঠনটির একদল নেতা-কর্মী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নগরের জিন্দাবাজার এলাকা থেকে চৌহাট্টা এলাকা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা ঘোষিত কমিটি যাচাই–বাছাই করে অযোগ্যদের বাদ দিয়ে সংশোধিত কমিটি ঘোষণার আহ্বান জানান। এ ছাড়া নতুন কমিটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও অনেকেই সমালোচনা করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ‘আওয়ামীঘেঁষা’ ব্যক্তি ঠাঁই পেলেও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, যোগ্য ও ত্যাগী অনেক নেতা কমিটিতে নেই। অথচ এসব নিবেদিতপ্রাণ নেতা ১৭ বছর ধরে দলীয় কর্মসূচিতে ছিলেন। সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় ব্যক্তিরা কমিটিতে থাকার পাশাপাশি একজনের নাম কমিটির দুটি পদেও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কমিটিতে একই পরিবারের একাধিক সদস্যও ঠাঁই পেয়েছেন। এ ছাড়া জেলা বিএনপি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের অনেক পদধারী নেতাও ঘোষিত কমিটিতে আছেন। ঠাঁই পেয়েছেন প্রায় এক বছর ধরে কারাগারে থাকা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বিএনপির সাবেক এক নেতাও।
বিএনপির তৃণমূলের একাধিক নেতা-কর্মী বলেছেন, বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সালেহ আহমদ খসরু, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হুমায়ূন আহমদ মাসুক, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী, সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক রেজাউল করিম নাচন, ২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মামুন ইবনে রাজ্জাক রাসেলসহ গুরুত্বপূর্ণ ১০ থেকে ১৫ জন নেতা ঠাঁই পাননি। অন্যদিকে জেলা বিএনপির কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা তিনজন নেতা মহানগর বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদেও ঠাঁই পেয়েছেন।
মহানগর বিএনপির সাবেক সহসভাপতি সালেহ আহমদ খসরু বলেন, ‘আমার বয়স ৬৪ চলছে। গত ১৭ বছর সিলেটে মিছিল-মিটিং হয়েছে আর আমি ছিলাম না, এমন নজির নেই। কমিটি কেন্দ্র দিয়েছে, আমার কোনো অভিযোগ, ক্ষোভ নেই। তবে যাঁরা গত ১৭ বছর পুলিশের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে আন্দোলন করেছে, এমন ব্যক্তিরাও ঠাঁই পায়নি, এটা ভেবে খারাপ লাগছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি, শরীর থেকে রক্ত ঝরেছে। এ রক্তের প্রতিটি ফোঁটা আমি কমিটিতে না থাকা নেতা-কর্মীদের উৎসর্গ করলাম।’
কমিটিতে ঠাঁই না পাওয়া মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক হুমায়ূন আহমদ বলেন, ‘কমিটিতে ঠাঁই না পেলেও শহীদ জিয়ার বিশ্বস্ত সৈনিক হিসেবে দলের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করব। কিন্তু আওয়ামীঘেঁষা ব্যক্তি আর নিষ্ক্রিয়রা ঠাঁই পেলেও বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখা বিএনপির নেতাদের কমিটিতে ঠাঁই হয়নি, এটা দুঃখজনক।