নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৮২ জন নিখোঁজ হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি। তবে তারা কেউ কারখানার শ্রমিক নন। মূলত কারখানার মালামাল লুটপাটকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতকারীরা কারখানায় আগুন দিয়েছে, এতে তারা নিখোঁজ হয়েছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি এই প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়। এসব তথ্যের বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক।
জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় রূপগঞ্জের রূপসীতে গাজী টায়ার কারখানায় আগুন লাগে। দীর্ঘ ৩২ ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কথা জানালেও ফের দফায় দফায় ভবনটিতে আগুন জ্বলে ওঠে। এর কয়েক ঘণ্টা পর আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি গত ১২ সেপ্টেম্বর ৩২ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে প্রতিবেদনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি জেলা প্রশাসন। সর্বশেষ গত রবিবার বিষয়টি জানাজানি হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট রূপগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানায় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কিছু ব্যক্তিকে অর্থের বিনিময়ে কারখানা পাহারার দায়িত্ব দেন। কয়েকদিন পর পাহারার দায়িত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বিরোধ সৃষ্টি হয়। একটি পক্ষ পাহারার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে। তা দিতে অস্বীকৃতি জানায় কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় হুমকি দিয়ে কারখানা ত্যাগ করে ওই পক্ষ।
এর মধ্যে ২৪ আগস্ট মধ্যরাতে গাজী টায়ার কারখানার মালিক সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ খবর জানাজানি হলে ২৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রূপসী এলাকায় আনন্দ মিছিল বের করা হয়। কিছুক্ষণ পর খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় বিক্ষোভকারীদের বিকাল ৩টায় রূপসী মোড় ও খাদুন মোড়ে জড়ো হওয়ার জন্য। এদিকে রূপসী এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে দুষ্কৃতকারীরা দুপুর ১২টায় খাদুন এলাকায় গাজী টায়ার কারখানায় ঢুকে ১৮০ জন শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বের করে দেয় এবং লুটপাট শুরু করে। বিকাল সাড়ে ৪টায় আরেক দল দুষ্কৃতকারী কারখানায় ঢুকে লুটপাট শুরু করে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দুষ্কৃতকারীরা একাধিক দলে ভাগ হয়ে লুটপাট করে। সেইসঙ্গে চলে সংঘর্ষও। একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে গাজী টায়ার কারখানার ছয়তলা বিশিষ্ট একটি পাকা মিক্সিং ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ভবনের প্রতিটি তলায় থাকা বিভিন্ন মালামালসহ যন্ত্রপাতি পুড়ে যায়। মূলত দুষ্কৃতকারীদের কারণে ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। এতে অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন বলে দাবি ওঠে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষার্থী ও তদন্ত কমিটি কর্তৃক গণশুনানিতে ভিন্ন ভিন্ন তালিকা তৈরি করা হয়। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে ১৮২ জন নিখোঁজ ব্যক্তির ঠিকানা পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট থেকে কারখানাটি বন্ধ ছিল। ফলে অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রতিষ্ঠানে কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন না। এজন্য কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিখোঁজ হননি। ওই দিন থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেনি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, অধিক পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় ২১ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পরে আবারও আগুন জ্বলে ওঠে। সর্বশেষ ৩০ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ৫৫ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন লাগার পর ১০-১৫ জন ব্যক্তি সেখান থেকে বের হয়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে সেখানে কোনও লাশ পাওয়া যায়নি। তবে ১ সেপ্টেম্বর ভবনের ভেতরে ১৫ খণ্ড হাড় পাওয়া যায়।
এতে আরও বলা হয়, ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক ভবনটিতে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সহায়তা চাওয়া হলে বুয়েট টিমসহ নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের প্রতিনিধি দল সরেজমিনে ফায়ার সার্ভিসের টিটিএল এবং ড্রোন দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর পরিদর্শন করে। ভবনের চার ও পাঁচতলার ছাদ ধসে তিনতলার ওপর পতিত হয়েছে। ভবনের কলামগুলো ফেটে গেছে। আগুনের তীব্রতা বেশি থাকায় ভবনের আরসিসি পিলার ও ছাদের ঢালাই খসে পড়ছে। অধিক তাপের কারণে বিভিন্ন ফ্লোরের বিম এবং ছাদের রডগুলো বাঁকা এবং এলোমেলো অবস্থায় আছে। ইটের দেয়ালগুলো বাঁকা হয়ে হেলে পড়েছে। ফলে ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এ অবস্থায় উদ্ধারকাজ চালানো উচিত হবে না এবং ভবনটি অপসারণ করতে হলে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। ফলে ভবনের ভেতরে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনে যে ১০ সুপারিশ করা হয়েছে তা হলো- আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধারকাজ সম্পাদন করা, ঘটনার পরিকল্পনাকারী ও দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করার জন্য রাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা/গোয়েন্দা সংস্থা/আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে অধিকতর তদন্ত করা, নিখোঁজ ব্যক্তিদের নামে নিবন্ধিত সচল মোবাইল নম্বরসমূহ উদ্ধার ও চিহ্নিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদি।
এদিকে গাজী টায়ার কারখানায় আগুন লাগার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে এই প্রতিবেদককে ফোন করে নিখোঁজ ভাতিজা মাসুদের খোঁজ জানতে চান তার চাচা মজিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘কারখানার সামনে গিয়ে আর কী লাভ হবে। এখন শুধু অপেক্ষায় আছি কবে একটা খোঁজখবর পাবো। জীবিত অথবা মৃত হোক, যেন একটা খবর পাই।’
নিখোঁজ আবু বকর নাঈমের মা নাজমা বেগম বলেন, ‘অনেক দিন হয়ে গেলো। কবে ছেলের খোঁজ পাবো? জীবিত না পেলেও অন্তত ছেলের হাড্ডিগুলো ফেরত দিক। যাতে এই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি।’
নিখোঁজদের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন হলে সেটিও করা হবে। এখানে নিখোঁজের যে তালিকা এসেছে, সেটা ফৌজদারি ইস্যু। ভবন অপসারণ করবে মালিকপক্ষ। তখন কোনও দেহাবশেষ ভবনে আছে কিনা সেটি আমরা খতিয়ে দেখতে পারি। বুয়েট টিম ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে দিয়েছে। ফলে এটা আমরা অপসারণ করতে পারি না। উদ্ধার হওয়া হাড় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিক্যালের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।’
একই বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার বলেন, ‘উদ্ধার হওয়া হাড়গুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। সেই রিপোর্ট এখনও আসেনি। এ ছাড়া নিখোঁজদের ফোন নম্বর আমাদের কাছে দেওয়া হয়েছিল। সেসব নম্বরের মধ্যে কিছু নম্বর খোলা পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ নম্বর বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’