দুই মাস অইছে (হয়েছে) স্বামী মারা গেছইন (গেছেন), ব্যাংকে পাঁচ লাখ টাকা রাখছিলা (রেখেছিলেন) তাইন (তিনি), এছাড়া আমার আর কোনতা (কিছুই) নাই, অখন (এখন) সংসার চলতো (চলবে) কেমনে (কীভাবে), বাসা ভাড়া কিলা (কিভাবে) দিতাম (দেব), কালকেও দশটা থাকি পাঁচটা পর্যন্ত বইয়া (বসে) গেছি। এসব কথা বলে চোখের পানি ঝরাচ্ছিলেন সুনামগঞ্জ শহরের বাঁধন আবাসিক এলাকার সীমা ভট্টাচার্য্য।
আমার স্ত্রী’র বেতনের টাকা থেকে প্রতি মাসে ১৮ হাজার টাকা ডিপিএস জমা দিয়েছিলাম, একটা ডিপিএস জানুয়ারি মাসে মেচিউর (পরিপক্ক) হবে। আর বাকিগুলো দুইবছর তিন বছর বাকি আছে। আমার হিসাব মতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৮ লক্ষ টাকা ডিপিএসে আছে পরিবারের। এখন টোটাল টাকা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি। গেল তিনদিন হয় প্রতিদিনই ব্যাংকে আসছি ডিপিএস ভাঙানোর জন্য, তারা আমলে নিচ্ছে না, বলছে টাকা নেই। শহরের নতুনপাড়া আবাসিক এলাকার নারায়ণ চক্রবর্তী অনুশোচনা করে এই বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চাইছিলেন। গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে তিনি অনুরোধ করছিলেন, গণমাধ্যমে মানুষের অসহায়ত্বেও কথা যেন তুলে ধরা হয়।
কেবল সীমা ভট্টাচার্য্য ও নারায়ণ চক্রবর্তী নয়। হাজারো গ্রাহক বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সুনামগঞ্জ ন্যাশনাল ব্যাংকে ভিড় করে করে কান্নাকাটি করছিলেন।
এদের মধ্যে কেউবা হাসপাতালে থাকা রোগীর জন্য খরচের টাকা তুলতে এসেছেন। কেউ—বা ছেলে— মেয়ের টিউশন ফি’র টাকা তুলতে এসেছেন। কেউ বাড়ি ভাড়া— কেউ পরিবারের দৈনন্দিন খরচের টাকা তুলতে ভিড় করেছেন। কেউ এসেছেন প্রবাস থেকে পাঠানো স্বজনের টাকা তুলতে,। ব্যাংকে টাকা না থাকায় বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা গালি—ধমক দিচ্ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা—কর্মচারীদের। গ্রাহকদের কথাবার্তা শুনেও কয়েকজন স্টাফ নিশ্চুপ বসেছিলেন।
শাহাব উদ্দিন নামের একজন প্রবাসী বললেন, আমি ৩০ লাখ টাকা পাঠিয়েছি। শরীর খাটিয়ে রোজগার করা টাকা। এক টাকাও উঠাতে পারিনি। এখন যদি টাকা না পাই, তাহলে আমার অবস্থা কী হবে। এই ভবন থেকে পড়ে মরা ছাড়া উপায় থাকবে না।
মাছুম মোহাম্মাদ তারেক নামের আরেক গ্রাহক বললেন, ভাই ক্রোয়েশিয়া থেকে টাকা পাঠিয়েছে। তিনি কয়েক দিন ধরে সকালে ব্যাংকে আসেন, বিকেলে ফিরেন, ব্যাংকের কেউ তার কথাই শুনতে চায় না। তিনি এখন কী করবেন, পরামর্শ চাইছিলেন এই প্রতিবেদকের কাছে। এভাবে অসংখ্য গ্রাহক ব্যাংকে টাকা রেখে বিপদের কথা শুনাচ্ছিলেন।
ব্যাংকে উপস্থিত কর্মকর্তা—কর্মচারীরা জানালেন, তাদের ব্যাংকে (সুনামগঞ্জ শাখায়) এখনো গ্রাহকরা একশ কোটি টাকার মতো পান। সকল গ্রাহকেই টাকা তুলে নেবার জন্য চেক পাঠাচ্ছেন, কিংবা ব্যাংকে এসে ডিপিএস বা ডিপোজিট প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।
জহুরুল ইসলাম নামের ব্যাংকের একজন জুনিয়র ক্যাশ অফিসার বললেন, সাময়িকভাবে সংকটে পড়েছে ব্যাংক। গ্রাহকরা ফিক্সট ডিপোজিট ভাঙানোর কারণে ক্রাইসেস বেড়েছে, প্রতিদিন গ্রাহকদের আতঙ্ক বাড়ছে। প্রাথমিক অবস্থায় ২০—৩০ হাজার টাকা করে বড় গ্রাহকদের দিচ্ছিলেন তারা। এখন সেটিও পারছেন না। স্বাভাবিক সময়ে এক দেড়শ চেক ক্যাশ করার জন্য আসতো। এখন তিনশ চেক আসছে। চাহিদা অনুযায়ী টাকা পাচ্ছেন না তারা।
ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার মো. মুজিবুর রহমান বললেন, ১৩ হাজার ৯৭২ গ্রাহকের ১৩৫ কোটি টাকা ছিল তাদের শাখায় (সুনামগঞ্জ শাখায়)। গেল দুই মাসে প্রায় সকলেই টাকা তুলে নিতে এসেছেন। ৩৫ কোটি টাকার মত তুলে নিয়েছেন তারা (গ্রাহকরা)। এখনো ১০০ কোটি টাকা পান এখানকার গ্রাহকরা। এই টাকা তুলতেই ব্যাংকে ভিড় করছেন গ্রাহকগণ।