সুনামগঞ্জের ধান জেলার চাহিদা পূরণ করে অন্যান্য জেলায় রপ্তানী হয়। এখানে চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমানে জেলায় সকল ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষরা কষ্টে আছেন। বড় বড় মিলার যারা আগে কম দামে ধান কিনেছেন, তাদেরকে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, সেদ্ধ চাল ৪৭ টাকা ও আতপ চাল ৪৬ টাকা দরে বিক্রয় করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে চাল ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ও অতিমুনাফালোভীরা মানুষকে জিম্মি করে দাম পণ্যের বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে বাজার তদারকি ও অভিযানে কিছু পণ্যের দাম কমেছে। অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করতে পারলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।
বৃহস্পতিবার বিকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে চালের বাজার মূল্য পরিস্থিতি উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষে চালকল মালিক, পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা বিএম মুশফিকুর রহমান বলেন, সারাদেশে যেভাবে চালের দর বেড়েছে সুনামগঞ্জে সেভাবে মোটা চালের দাম খুব একটা বাড়েনি। আমি দেখেছি, ৪৭, ৪৮ টাকার ভেতরে মোটা চাল প্রতিকেজি বিক্রয় হচ্ছে। এখন কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে, আগের মতো ৬০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রয় হয় না। গেল বছরও ৩২ টাকা কেজি দরে আমরা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনেছি।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জে ম্যঙ্মিাম ধান ২৮ ও ২৯। ভৈরব, আশুগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সুনামগঞ্জের ধান দিয়ে সারা বছর চলে। সুনামগঞ্জে আমন ফসল কম হয়, আমন কাটার আগে বাজারে এফেক্ট হয়। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মিল মালিকদের কাছে বেশি পরিমাণ ধানের মজুত নাই। সবাই এখন আমন ধান কেনার চেষ্টা করবে। লাইসেন্স ছাড়া যারা ব্যবসা করছে, তাদের জরিমানা করা হচ্ছে। এছাড়াও বাইরে থেকে চাল আনার জন্য শুল্কমূল্য কমানো হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় অটো রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি জিয়াউল হক বলেন, আমাদের মূল ফসল বোরো। আমরা বিআর ২৯ (মাঝারি চিকন) ধান যখন কিনেছি, তখন ১২০০ টাকা মণ ছিল। সরকারের অফারের প্রেক্ষিতে বরাদ্দের অতিরিক্ত ১৪০০ মে.টন চাল সরকারকে দিয়েছি, বাজারেও ছেড়েছি। পরে চেষ্টা করেও আর ধান কিনতে পারিনি।
তিনি বলেন, গ্রামে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এক থেকে তিন হাজার মণ পর্যন্ত ধান স্টক করে রেখেছে। আমরা গ্রাম থেকে ধান আনতে গেলে কিছু খরচ হয়, কিন্তু গ্রামের ব্যবসায়ীরা একই দামে কিনে মজুত করে রাখে। এখন ধানের মণ ১৬০০ টাকা, কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা ধানই পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, বর্তমানে মিলাররা লস দিয়ে ধান বিক্রি করছেন। এক মণ বিআর ২৯ (মাঝারি চিকন) ধানে ২৬ কেজি চাল হয়। এদিকে মোটা ১৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। মোটা প্রতি মণ ধানে ২৭ কেজি চাল হয়। ৫০ কেজি চালের বস্তা পড়ে ২৪০০ টাকা, কিন্তু আমরা ২১০০ টাকায় বিক্রি করছি। খুচরা ব্যবসায়ীরা কিনছেন ২১৫০ টাকায়।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে দুইটি চাল আছে, চিকন আর মোটা। দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, নওগাঁর চাল বাজার উর্ধ্বমুখী রাখে। ওরা বিভিন্ন ধরনের নাম দিয়ে চাল বিক্রি করে। ওই জায়গাটা আপনারা শক্ত করে ধরতে পারলে দামটা একটু কমবে।
সভায় খুচরা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. তছলিবুর রহমান সরকার নির্ধারিত দামে চাল বিক্রির অঙ্গিকার করেন।
সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি পঙ্কজ কান্তি দে বলেন, মধ্যনগরে ও শাল্লায় যারা ধান বিক্রি করেন তারা বলেছেন— মিলাররা ইচ্ছে করলে ২২০০—২৩০০ টাকায় মোটা চাল বিক্রি করতে পারেন। এক্ষেত্রে অবশ্য খুচরা বিক্রেতাদের কিছু করার নেই, কারণ তারা মহাজনের কাছ থেকে ধান এনে বিক্রি করেন। বাজার স্থিতিশীল রাখতে মিল মালিকদের আন্তরিক থাকার অনুরোধ করেন তিনি।
তিনি বলেন, বহু মিলার আছেন যারা আগে ৮০০, ১০০০ ও ১১০০ টাকা মণে দরে ধান কিনেছেন। অনেকের কাছে হাজার হাজার বস্তা ধান স্টকও আছে। যেহেতু আমরা ধান আমদানি করছি না, অন্য কোন জেলা থেকেও আনতে হচ্ছে না, তাই বাজার স্থিতিশীল রাখতে মিলারদের—পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের দিকটি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
সুনামগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আল আমিন বললেন, সাম্প্রতিক সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বি হয়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। তিনি বলেন, আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি— প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে পণ্যের দাম বাড়ে। এছাড়াও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ও অতিমুনাফালোভীরা মানুষকে জিম্মি করে দাম পণ্যের বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও কিছু কিছু জেলায় বন্যার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দাম বেড়েছে। এখন সবজিসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে, কিছু পণ্যের দাম বেড়েছেও।
তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের উৎপাদিত চাল জেলার চাহিদা পূরণ করে অন্য জেলায় যায়। সুনামগঞ্জে যেখানে অতিরিক্ত চাল হয়, সেখানে কেন চালের দাম বাড়ে, এটা আমরা মানতেই পারি না। এক্ষেত্রে অনিয়মকারীদের চিহ্নিত করতে পারলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, আজকের সভার ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যে অর্থাৎ সেদ্ধ চাল ৪৭ টাকা ও আতপ চাল ৪৬ টাকা দরে বিক্রয় করতে হবে। সরকারি নির্দেশনা সকলকে মানতে হবে। নির্দেশনা মানা না হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে।