সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রসোনারথাল হাওর। ছবি: প্রতিদিনের সংবাদ
হাওরে আগাম বন্যা থেকে ফসল রক্ষায় প্রতিবছরই নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী মাটির বাঁধ। শত শত কিলোমিটার মাটির বাঁধ নির্মাণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। পাহাড়ি ঢলের পানির প্রবল শ্রোতে এক সময় সেই বাঁধ ভেঙে যায়। পরের বছর একইভাবে ফের নির্মাণ করা হয় বাঁধ। প্রতি বছর বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে একদিকে মাটি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে, এতে দেখা দিয়েছে মাটির সংকট। অপরদিকে বাঁধের মাটি মিশে ভরাট হচ্ছে হাওরের নদ নদী এবং ঢেকে যাচ্ছে কৃষিভূমির পলল জমিন। অপচয় হচ্ছে সরকারের শত শত কোটি টাকা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাষিরা স্থায়ী বাঁধের দাবি তুলছেন।
সুনামগঞ্জের হাওরে প্রধান ফসল বোরো ধান, বলা যায় একটি মাত্র ফসল এটি। এ ফসলের ওপর নির্ভরশীল জেলার ৭৭ শতাংশ মানুষ। মার্চ-এপ্রিল থেকে কৃষকরা বোরো চাষাবাদ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন। আর এ বোরো ফসল রক্ষায় অস্থায়ী ফসলরক্ষা বাঁধ সংস্কার ও মেরামত করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসনের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে প্রতিবছরই ৭০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার মাটির বাঁধ করা হয়। এবারও ৭৩৪টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৫৫৮ কিলোমিটার মাটির বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়।
মার্চ এপ্রিলে কিংবা জুনে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে যায়, বাঁধের মাটি হাওর ও নদীতে মিশে। এতে করে একদিকে নাব্যতা হারায় নদী। দেখা দেয় মাটি সংকট। হাওর হারায় তার প্রাণবৈচিত্র্য। সরকারের অর্থ অপচয় হয়। বাঁধের মাটি আনতে হয় দুর-দুরান্ত থেকে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হাওরে স্থায়ী বাঁধ করার জন্য দীর্ঘদিনের দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকার কৃষকরা।
জেলার তাহিরপুর উপজেলার কৃষক রামেন্দ্র নারায়ণ বলেন, এভাবে প্রতি বছর মাটি দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হলে একসময় হাওরে মাটি সংকট দেখা দিবে। এছাড়াও প্রতিবছর যে বাঁধ করা হয় বর্ষায় সে বাঁধের মাটি হাওরে গিয়ে হাওর উঁচু হয়ে যাচ্ছে। আবাদি জমির ঊর্ব্বরতা নষ্ট হচ্ছে। আর নদী ভরাট হওয়ায় বন্যার ঝুঁকিতে ফসল নষ্ট হওয়ায় আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
একই উপজেলার আসাদুর রহমান বলেন, এখনি মাটির সংকট দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও মাটির বদলে পলিমাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। হাওরের প্রাণবৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আমরা চাই ফসল রক্ষায় সরকার বিকল্প চিন্তা করুক।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা জানান, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের সমীক্ষা চলমান। আপাতত ১২টি হাওরে স্থায়ী বাঁধ করার পরিকল্পনা আছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
সম্প্রতি হাওরের বাঁধের কাজ পরিদের্শনে এসে পানি উন্নয়ন বোর্ড মহাপরিচালক আমিরুল হক ভূঁইয়া জানান, আমাদের চিন্তাভাবনা আছে হাওরে স্থায়ী বাঁধ করার। যাতে বছর বছর মাটির বাঁধ করতে না হয়। এরই মধ্যে সমীক্ষার কাজ চলছে। আশা করছি আগামী বছর বিকল্প চিন্তা ভাবনা করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে সুনামগঞ্জের বোরো ফসলরক্ষায় জেলার ৭২৪টি প্রকল্পের মাধ্যমে মাটির বাঁধ করা হয়েছিল। যার ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৯ কোটি টাকা। এরপরও আগাম বন্যায় জেলার দিরাই, শাল্লা ও তাহিরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি বাঁধ ভেঙে ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। ২০২৩ সালে জেলায় ২০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে ১ হাজার ৭৬টি পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে ছোট-বড় ৫৪টি হাওরে ৭৪৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে।
২০১৭ সালের পরে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে জেলার শতভাগ ফসল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে কাবিটা নীতিমালা সংশোধন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে বাঁধের কাজ করা হয়। অর্থাৎ যার জমি সেই করবে বাঁধের কাজ।